ঢাকা শহরে নতুন এসেছেন, অথচ একা একাই পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছেন! কীভাবে সম্ভব? সম্ভব শুধুমাত্র গুগল ম্যাপের জন্যই৷ আর এই আশ্চর্যজনক প্রযুক্তির পিছনে রয়েছে জিপিএস (GPS)। কিন্তু জিপিএস কি, এর ইতিহাস, এটি কীভাবে কাজ করে, এর বহুবিধ ব্যবহার এবং এই জিপিএস বন্ধ হয়ে গেলে কী ঘটতে পারে, এসব আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই জানতে হলে পড়ে ফেলুন পুরো আর্টিকেলটি।
পুরো বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। অর্থাৎ ঘরে বসেই আপনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো কিছু দেখতে পারেন। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আপনার স্মার্টফোনে থাকা গুগল ম্যাপ। এর মাধ্যমে আপনি বিশ্বের প্রতিটি দেশ, সাগর, পর্বত, নদী-নালা, দালান-কোঠা এমনকি ঢাকা শহরের অলিগলি সহ দেখতে পারেন৷ কিন্তু কীভাবে? এটিই জিপিএস এর বিশেষত্ব। এছাড়াও এই জিপিএসের রয়েছে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যকারিতা। আজকের আলোচনায় আমরা জিপিএস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
জিপিএস কী?
জিপিএস (GPS) বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। এর পূর্ণরূপ হলো, ‘Global Positioning System‘। এটি কৃত্রিম উপগ্রহ ভিত্তিক একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা। এটি মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত স্যাটেলাইট নির্ভর একটি Radio Navigation System. এর প্রধান কাজ হলো, যে কোনো পরিস্থিতিতে পৃথিবীর যে কোনো স্খির বা চলমান বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করা।
জিপিএর এর ইতিহাস
জিপিএসের প্রধান আবিষ্কারক হলো মার্কিন সামরিক বাহিনী। ষাটের দশকের মার্কিন নৌবাহিনী ট্রানজিট স্যাটেলাইট দ্বারা সৃষ্ট প্রাথমিক জিপিএস ব্যবস্থা পরিচালনা করতো। তবে জিপিএসের মূল কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালের দিকে। মার্কিন নৌবহর জিপিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে সাবমেরিন ও অন্যান্য নৌযানের অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতো। পরবর্তীতে নিখুঁতভাবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কাজে জিপিএসের বহুল ব্যবহার শুরু হয়।
পরে ১৯৮৩ সালে যখন মার্কিন বেসামরিক একটি বিমান ভুলে রাশিয়ার সীমানায় ঢুকে পড়ে এবং রাশিয়া সেই বেসামরিক বিমানটির উপর হামলা করে ধ্বংস করে দেয় তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সামরিক এই প্রযুক্তিকে বেসাসরিক সকল বিমানেও ব্যবহারের জন্য অনুমোদন করেন।
এরপর ঠিক ১২ বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে আমজনতার জন্যও জিপিএস চালু করা হয়৷ যদিও তখনকার সময়ে এই প্রযুক্তি এতটা নির্ভুল ছিল না। পরবর্তীতে ২০০৫ থেকে ২০১৫ এর মধ্যে ইউএস এয়ারফোর্স প্রায় ৫০ টির মতো GPS স্যাটেলাইট চালু করে। যার দরুন আজকের জিপিএস প্রযুক্তি এত শক্তিশালী হয়েছে। যা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় আপনার অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম।
জিপিএস কীভাবে কাজ করে?
পূর্বে মানচিত্র, কম্পাস, স্কেল ইত্যাদি দিয়ে মেপে এবং অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের কোনো স্থানের অবস্থান নির্ণয় করা হতো৷ বিজ্ঞানের এই আশ্চর্যজনক উদ্ভাবনে এখন খুব সহজে ও নিখুঁতভাবে পৃথিবীর কোনো স্থানের অবস্থান আমরা জানতে পারি। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, গাড়ি, জাহাজ, প্লেনেও এর মাধ্যমে অবস্থান নির্ণয় করা যায়। কিন্তু ভাববার বিষয়, এটি কীভাবে কাজ করে?
জিপিএস সিস্টেমের পিছনে ২৪/৭ কাজ করছে ২৪ টি স্যাটেলাইট৷ আরো তিনটি স্যাটেলাইট রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়েছে কক্ষপথেই।
ভবিষ্যতে কখনো কোনো স্যাটেলাইট অকেজো হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য ওই তিনটা অতিরিক্ত স্যাটালাইট ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হয়েছে। আর এই ২৪ টি স্যাটেলাইটের প্রত্যেকটি ভূপৃষ্ঠ হতে ২০,০০০ কিলোমিটার উপরে ৬টি অরবিটে অবস্খান করছে। এ স্যাটেলাইটগুলো ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীকে দুইবার করে প্রদক্ষিণ করে থাকে।
৬টি অরবিট এমনভাবে সাজানো হইছে যাতে ভূপৃষ্ঠের যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো মুহূর্তে অন্ততপক্ষে চারটি স্যাটেলাইট দৃশ্যমান হতে পারে।
প্রত্যেকটি স্যাটেলাইটে একটি করে পারমানবিক ঘড়ি লাগানো থাকে। এটি এমন একটি ঘড়ি, যা এক মিলিয়ন বছর পরও একেবারে নিখুঁত সময় ধরে রাখতে সক্ষম। এ অবস্থায় স্যাটেলাইটগুলো পৃথবীতে সংকেত পাঠাতে থাকে। এই সংকেট পাঠাতে তিনটি তথ্যের প্রয়োজন হয়। যথা- ১. কোন স্যাটেলাইট থেকে সিগনাল পাঠানো হলো। ২. কোন ডিভাইসে সিগনাল পাঠানো হলো। এবং ৩. স্যাটেলাইট থেকে ডিভাইসে সিগনাল পাঠানোর মধ্যবর্তী সময়। অর্থাৎ কোন স্যাটেলাইট থেকে যখন কোন ডিভাইসে কোনো সিগনাল পাঠানো হয় তখন এর সাথে একটি টাইমও সেট করে দেওয়া হয়। এই সিগনালের গতি হয় প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ৫০ বাইটস।
যদি আপনার ডিভাইস বা GPS ইউনিট ৩টি স্যাটেলাইট এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে তবেই এটি আপনার অবস্থান নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ আপনার যে ডিভাইসটি সিগনাল রিসিভ করে সে জানে কখন, কোন স্যাটেলাইট থেকে সিগনালটি পাঠনো হয়েছে এবং তার অবস্থান৷ তারপর এসব তথ্যকে কেন্দ্র করেই ডিভাইস তার নিজের অবস্থান ও সময়ের ক্যালকুলেশন করে আপনাকে আপনার সঠিক অবস্থান জানিয়ে দেয়। আর হ্যাঁ, আপনার অবস্থান নিখুঁতভাবে নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজন তিনটি স্যাটেলাইটের সিগনাল। আর যদি আপনার ডিভাইস চারটি স্যাটেলাইটের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে তাহলে এটি সমুদ্রতল থেকে আপনার অবস্থানের উচ্চতাও মাপতে সক্ষম হবে।
জিপিএস কী কী কাজে ব্যবহার করা হয়?
বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের আশ্চর্য সব আবিষ্কার দিনে দিনে আমাদের জীবনমান কতই না সহজ করে দিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি আবিষ্কার হলো জিপিএস (GPS)। যা প্রতিনিয়ত আমাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে।
১. যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলায় জিপিএস অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্খা গ্রহণ করতে পারি।
২. প্রতিদিন হাজার হাজার বিমান, উড়োজাহাজ আকাশপথ দিয়ে দেশদেশান্তরে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এসব বিমান, উড়োজাহাজের সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ল্যান্ড করার পিছনে যে জিনিসটি কাজ করে, তা হলো এই জিপিএস। এছাড়াও যুদ্ধবিমান থেকে শত্রুপক্ষের ঘাঁটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার মতো নিখুঁত কাজটিও করে এই জিপিএস।
৩. বিশাল বিশাল সব সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জাহাজগুলো কীভাবে এত সহজে তাদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে? এই জিপিএসই তাদেরকে গন্তব্যের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।
৪. জিপিএসের জন্যই আজকাল অপরাধীরা অপরাধ করে লুকিয়ে থাকতে পারে না। বর্তমানে অপরাধীদের ধরতে এই জিপিএস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।
৫. প্রিয়জনদের উপর নজরদারী রাখতে, এক জায়গা থেকে অচেনা কোনো জায়গায় ভ্রমণে গেলে সঠিক রাস্তা, যাত্রাকাল এমনকি যানজটের গতিবিধিও আমরা এই জিপিএসের মাধ্যমেই পর্যবেক্ষন করতে পারছি।
৬. মোবাইল, বাইক, কার বা যে কোনো মূল্যবান ডিভাইস চুরি বা হারিয়ে গেলে জিপিএসের মাধ্যমে Anti-theft Device এর আদলে লোকেশন ট্রাক করে আমরা সেগুলো ফিরে পাই।
৭. বর্তমান সময়ের স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচ গুলোতে জিপিএস টেকনোলজির মাধ্যমে আমাদের শারীরিক কার্যকলাপগুলো ট্র্যাক করতে পারছি। যেমন- কত স্টেপ হাটলেন, কতদূর হাটলেন, কতক্ষণ ঘুমালেন এসবই এখন জিপিএসের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি।
জিপিএস বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে?
যুক্তরাজ্যের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র পাঁচ দিনের জন্য যদি জিপিএস বন্ধ রাখা হয় তাহলে কৃষি কাজ, নির্মাণ কাজ, ফিশিং সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিদিন এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে। এতকিছু ভাবতে হবে না, আপনি নিজেই চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন তো- জিপিএস প্রযুক্তি ব্যতীত অপরিচিত কোথাও গেলে সঠিক লোকেশন খুঁজতে খুঁজতে বেহাল দশা হবে। উবারের ড্রাইভারকে আর খুঁজে পাবেন না। ফুডপান্ডার মাধ্যমে অর্ডার করে খাবার আনতে পারবেন না, কারো সাথে লোকেশন শেয়ার করতে পারবেন না অর্থাৎ তাকে খুঁজে পেতে পেতে বারোটা বেজে যাবে।
এছাড়াও বৈশ্বিক যে সমস্যাগুলো সম্মুখীন হতে হবে- আকাশ পথে উড়োজাহাজ, জল পথে জাহাড় দিকভ্রান্ত হয়ে যাবে। শত্রুদের নজরদারি করছে যেসব ড্রোন, সাবমেরিন, তার প্রতিটিই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে৷ ব্যাংকিংখাতে জটিলতা বাড়বে। চোর, আসামীদের ধরতে কষ্ট হয়ে যাবে।
তবে আশার আলো এই যে, এ ধরনের বিপর্যয় থেকে বাঁচতে বিকল্প হিসেবে ফাইবার অপটিক কেবল দিয়ে গ্রাউন্ড বেসড সিস্টেম তৈরি হচ্ছে৷ এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত জিপিএস-ই কেবল একমাত্র গ্লোবাল নেভিগেশনাল সিস্টেম নয়৷ রাশিয়া, চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেরও রয়েছে নিজস্ব নেভিগেশনাল স্যাটেলাইট সিস্টেম। জাপান ও ভারতও চেষ্টা করছে নিজেদের নেভিগেশনাল স্যাটেলাইট সিস্টেম তৈরি করতে৷ অতএব চিন্তার কোনো কারণ নেই। আশাকরি একদিন বাংলাদেশেও নিজস্ব নেভিগেশনাল স্যাটেলাইট সিগনাল তৈরি করতে সক্ষম হবে।
আরও জানুন –ডাটা রিকভারি কি, কেন এবং কিভাবে কাজ করে?