পুরো দুনিয়া যেখানে স্মার্টফোনে বন্দি সেখানে এটাকে ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলো সম্পন্ন করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। অফিসের কাজ থেকে শুরু করে কেনাকাটা, পড়ালেখা, যাতায়াতের জন্য টেক্সি ডাকা, বিনোদন সহ প্রত্যাহিত জীবনের প্রতিটি কাজে স্মার্টফোন এক অবিচ্ছেদ্য ডিভাইসে পরিণত হয়েছে৷ অতএব এতসব কাজ সম্পন্ন করতে নিশ্চয়ই স্মার্টফোনটিকে চালু রাখতে হয়৷ আর স্মার্টফোনটিকে চালু রাখে ব্যাটারি।
কিন্তু এই ব্যাটারিই যদি দুর্বল হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় তাহলেই পড়তে হয় বিপাকে৷ কাজের মাঝে চার্জ না থাকার ফলে ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কাজ রেখে বার বার ফোন চার্জে দেওয়াটাও বেশ বিরক্তিকর। অবশ্য নির্দিষ্ট সময়ের আগে ব্যাটারি দুর্বল বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পিছনে আমাদের অসচেতনতাই বেশি দায়ী৷ তাই আজকের আলোচনায় আমরা স্মার্টফোনের ব্যাটারি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ব্যাটারির কার্যপ্রনালী
বর্তমানে সারাবিশ্বে ব্যাটারিচালিত যত ধরনের ডিভাইস আছে সবগুলোতে অন্যান্য ব্যাটারির তুলনায় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। কারণ তুলনামূলকভাবে এটি সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির দুটো ইলেক্ট্রোড থাকে৷ একটি ধনাত্মক আয়নের ক্যাথোড আরেকটি ঋণাত্মক আয়নের অ্যানোড। দুটো অংশকে আলাদা করে রাখে খুবই পাতলা একটি প্লাস্টিকের পর্দা। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি যখন চার্জ দেওয়া হয় তখন ক্যাথোড থেকে লিথিয়াম আয়নগুলো বল প্রয়োগের কারণে অ্যানোডের অংশে ধাবিত হয়। ফলে ব্যাটারি চার্জ হতে থাকে এবং একইভাবে ব্যাটারিটি যখন কোনো কাজে ব্যবহার করা হয় তখন লিথিয়াম আয়ন অ্যানোড থেকে ক্যাথোডের দিকে ছুটে যায় ফলে চার্জ কমতে থাকে৷ আর ব্যাটারির এই কার্যপ্রনালীতে ব্যাঘাত ঘটলেই ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যায়।
স্মার্টফোনের ব্যাটারি নষ্ট হবার কারণ ও প্রতিকার –
অনেক কারণেই আপনার স্মার্টফোনের ব্যাটারিটি নষ্ট হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাটারি নষ্ট হবার পিছনে আমাদের অসচেতনতাই দায়ী। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে আমাদের স্মার্টফোনের ব্যাটারি নষ্ট হয় এবং এর প্রতিকার –
১. সারারাত ফোন চার্জে রাখা:
আমাদের মধ্যে অনেকেরই এই বাজে অভ্যাসটি রয়েছে৷ রাত পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ব্যবহার করি। পরে ঘুম এলে ফোন চার্জে লাগিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ি৷ অতএব সারারাত ফোন চার্জে লাগানো থাকে। ফলে ব্যাটারি নির্দিষ্ট পরিমাণ চার্জ হবার পরও অতিরিক্ত লোড নিতে থাকে। এতে ব্যাটারি গরম হয়ে যায়৷ এভাবে অল্প কয়েকদিন চলতে থাকলে ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যায়। শুধু ব্যাটারি নয়, ফোনের জন্যও এটি বেশ ক্ষতিকর। এমনকি অনেক সময় ব্যাটারি বিস্ফোরণের ফলে আরো বড় ধরনের দূর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
তাই এ কাজটি থেকে বিরত থাকা উচিত৷ নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় ফোন চার্জে লাগিয়ে রাখা যাবে না। বিশেষ করে সারারাত কখনই না।
২. বিভিন্ন চার্জার ব্যবহার করা:
আমাদের আরেকটি বদঅভ্যাস হলো, যখন যেই চার্জার হাতের কাছে পাই সেই চার্জার দিয়েই ফোন চার্জ দিয়ে থাকি। অথচ একেক চার্জারের একেক ওয়াটের হয়ে থাকে। আর ফোন কোম্পানিগুলো ফোন ও ব্যাটারির ক্ষমতা অনুসারে চার্জারের ওয়াট নির্ধারণ করে থাকে। অতএব একেক সময় একেক ওয়াটের চার্জার ব্যবহারের ফলে ব্যাটারির চার্জ ধারন ক্ষমতা কমতে থাকে।
অতএব ফোনের নির্দিষ্ট অরিজিনাল চার্জার দিয়ে ফোন চার্জ দিন। অরিজিনাল চার্জার হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে নির্দিষ্ট ওয়াটের এবং একই কোম্পানির নতুন চার্জার কিনুন। একাধিক চার্জার ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকুন।
৩. নিয়ম অনুযায়ী চার্জ না দেওয়া:
মোবাইলেই চার্জ দেওয়ার সঠিক নিয়ম হলো ৯০% চার্জ হওয়ার পর চার্জ থেকে ফোন বিচ্ছিন্ন করা এবং ফোনের চার্জ ১৫% এ চলে আসলে চার্জ দেওয়া৷ কিন্তু আমরা তো এই নিয়ম পালন করিই না বরং ১০০% হলেও চার্জে লাগিয়ে রাখি, চার্জ শেষ হতে হতে ৫% এ এলেই চার্জে লাগাই না। যখন ফোন একেবারে চার্জ শূন্য হয়ে বন্ধ হয়ে যায় তখন চার্জে লাগাই। অনেকেই আবার ৫০%/৬০% অর্থাৎ যখনি সুযোগ হয় তখনি চার্জে লাগাই। চার্জে লাগানোর এই অনিয়মের কারণে ফোনের চ্যাটারির অনেক ক্ষতিসাধন হয় এবং ব্যাটারির কার্যক্ষমতা কমতে থাকে।
অতএব অনিয়মিতভাবে ফোন চার্জ
না দিয়ে ৯০% হলে চার্জ থেকে ফোন বিচ্ছিন্ন করুন এবং ফোন ০% চার্জ পর্যন্ত ব্যবহার না করে ১৫% এ এলেই চার্জে লাগিয়ে নিন।
৪. চার্জে লাগিয়ে ফোন ব্যবহার করা:
ফোন ব্যবহারে আমাদের বাজে অভ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো চার্জে লাগিয়েই ফোন ব্যবহার করি। এটি শুধু ব্যাটারির জন্যই ক্ষতিকর না, এটি আপনার ফোনের জন্যও বেশ ক্ষতিকর। অনেকেই আছে, চার্জে লাগিয়েই ফোনে কথা বলেন। এটি ব্যক্তির কানে এবং মস্তিষ্কেও ক্ষতিসাধন করে থাকে। এমনকি ফোন বিস্ফোরণের মতো মারাত্মক ঘটনাও ঘটতে পারে এই চার্জে লাগিয়ে ফোন ব্যবহারের কারণে৷ ইতোমধ্যে যার প্রমাণ আমরা নিউজপেপার ও ফেসবুকে প্রায়ই দেখতে পাই।
এছাড়াও কম দামি চার্জার ব্যবহারের ফলে, পাওয়ার ব্যাংক দিয়ে চার্জ লাগানো অবস্থায় ফোন ব্যবহার করলে, ফোনের কভার লাগানো অবস্থায় চার্জে লাগালেও ফোন গরম হয়ে ব্যাটারির ক্ষতিসাধন করে থাকে। তাই আমাদের উচিত উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে সচেতন থাকা।
Read More: আইফোন কেনার আগে কি কি যাচাই করতে হবে? নতুন বা পুরাতন
স্মার্টফোনে ব্যাটারির চার্জ দ্রুত শেষ হবার কারণ ও প্রতিকার –
সাধারণত আমরা যে স্মার্টফোনগুলো ব্যবহার করে থাকি সেগুলোর ব্যাটারির চার্জ একাধারে ৭/৮ ঘন্টা ব্যাকআপ দিয়ে থাকে। কিন্তু অনেকেই অভিযোগ করেন, তার ফোনের চার্জ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। ফলে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সময়মত সম্পন্ন করতে পারেন না। মূলত না জানার ফলে আমরা নিজেরাই বিভিন্নভাবে ফোনের চার্জ দ্রুত শেষ করে ফেলি। অথচ একটু খেয়াল রাখলেই আমরা আমাদের স্মার্টফোনের চার্জের স্থায়ীত্ব বাড়াতে পারি। তো চলুন, জেনে নেওয়া যাক –
১. এখনকার স্মার্টফোন গুলোর সাইজ যেহেতু অনেক বড় তাই পুরো ডিসপ্লে আলোকিত করতে অনেকগুলো লাইট ব্যবহার করতে হয়৷ আর এই লাইটগুলো বেশ চার্জ ব্যয় করে৷ অপরদিকে আমরা অনেকেই ফোনের ফুল ব্রাইটনেস দিয়ে ফোন ব্যবহার করে থাকি৷ এটা করবেন না। যত কম ব্রাইটনেসে ফোন ব্যবহার করা যায় ব্যাটারির চার্জ ততই স্থায়ী হবে। আর হ্যাঁ, অতিরিক্ত ব্রাইটনেস কিন্তু চোখের জন্যও ক্ষতিকর।
২. সবচেয়ে বেশি চার্জ ব্যয় হয় ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে। তবে আমরা কিন্তু সবসময়ই ইন্টারনেট ব্যবহার করি না। ইন্টারনেটের বাইরেও অনেক কাজ করি। অতএব যখন ইন্টারনেটের প্রয়োজন হবে না তখন ডাটা কানেকশন অফ রেখে যাবতীয় কাজগুলো করবেন। এতে চার্জের অপচয় হবে না।
৩. আমরা অনেকেই ফোন ডিসপ্লের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন লাইভ ওয়ালপেপার ব্যবহার করে থাকি৷ এটিও আপনার ফোনের চার্জ দ্রুত শেষ করে। তাই ফোনের চার্জ বাঁচাতে লাইভ ওয়ালপেপার ব্যবহার না করে ফোনের ডিফল্ট ওয়ালপেপার ব্যবহার করুন।
৪. প্রয়োজন ছাড়া জিপিএস, ব্লুটুথ সহ অন্যান্য অপশনগুলো বন্ধ রাখুন। বিশেষ করে জিপিএস প্রতিটি মুহূর্তে চার্জ শেষ করে কারণ এটি অন থাকলে প্রতিটি মুহূর্তে এর কাজ চলতে থাকে।
৫. যখন কোনো একটি অ্যাপস ব্যবহার করবেন তখন শুধু ওই অ্যাপসটিই চালু রাখবেন। বাকিসব অপ্যাসগুলো পুরোপুরি অন্ধ রাখবেন। নতুবা বাকি অ্যাপসগুলোতে কাজ না করলেও ব্যাকগ্রাউন্ডে চলমান থাকে। এতে আপনার অজান্তেই অ্যাপসগুলো চার্জ খরচ করতে থাকবে। তাই বাকি অ্যাপসগুলো বন্ধ রাখবেন।
৬. আমরা অনেকেই ফোনের ভাইব্রেশন অপশনটি চালু রাখি। এমনকি অনেকেই টাচ ভাইব্রেশনও অন করে রাখি। এটিও আপনার ফোনের চাজ নষ্ট করে। তাই আপনার ফোনটি ভাইব্রেশন মুডে না রেখে জেনারেল মুডে রাখুন।
৭. বর্তমানের প্রত্যেকটি স্মার্টফোনে Power Savings Mode অপশন থাকে। এটি আপনার ফোনের পাওয়ার সেভ রাখতে বেশ সহায়তা করে। অতএব ফোনের সেটিংস অপশন থেকে এখনি Battery Savings Mode অন করে দিন।
মোটকথা, আপনার স্মার্টফোনের ব্যাটারিটি ভালো রাখতে আপনাকেই সর্বোচ্চ সচেতন থাকতে হবে৷ একমাত্র সচেতনতাই পারে আপনার ফোন, ব্যাটারি এবং আপনাকে ভালো রাখতে। অতএব ভালো থাকুক আপনার শখের স্মার্টফোনটি এবং ভালো থাকুন আপনি নিজেও৷ আর হ্যাঁ, এরকম ভালো ভালো টিপস পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
Read More: হ্যাকিং থেকে বাঁচার ৯টি উপায় | মোবাইল এবং কম্পিউটার হ্যাকিং